৭ মার্চ: বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, ঢাকার রেসকোর্স
ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক
ভাষণ নাড়া দিয়েছিল বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক
গণমাধ্যমকে। ১৯৭১ এর ৫ মার্চ দ্য গার্ডিয়ান, সানডে টাইমস, দি অবজারভার
এবং ৬
মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ৭
মার্চে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার
দিক-নির্দেশনামূলক ঘোষণার পূর্বাভাস দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ওয়াশিংটন পোস্টে উল্লেখ করা হয়, শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার
মৌলিক ঘোষণা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়েছে ওই ভাষণের আলোকেই।
বিবিসিতে বলা হয়েছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের
সঙ্গে তুলনীয় শেখ মুজিবের ভাষণটি।
তিনি একাধারে বিপ্লবী ও রাষ্ট্রনায়ক। রয়টার্স-এর ভাষ্যমতে, ইতিহাসে
এই ভাষণের মতো সুপরিকল্পিত এবং সুবিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একইসঙ্গে বিপ্লবের রূপরেখা এবং দেশ পরিচালনার দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নিউজ উইক পত্রিকার নিবন্ধে বলা হয়েছে, ৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, একটি অনন্য কবিতা। নিউজ উইক পত্রিকাই বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অফ পলিটিক্স’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল।
১৯৭২ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার এক
নিবন্ধে বলা হয়, উত্তাল জনস্রোতের মাঝে এমন ভারসাম্যপূর্ণ, দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণই শেখ মুজিবকে অনন্য এক ভাবমূর্তি দিয়েছে, দিয়েছে মহান নেতার মর্যাদা।
টাইম ম্যাগাজিনে ঐতিহাসিক
এই ভাষণ নিয়ে বলা হয়েছে, শেখ মুজিব ৭
মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ওই
ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের কৌশল ছিল।
১৯৭১ সালে এএফপির ভাষ্য ছিল, ৭ মার্চের ভাষণের
মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান।
ওই দিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়
ঘটে।
শুধু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমই নয়, বিশ্ব নেতৃবৃন্দও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণকে যুগান্তকারী দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ হিসাবে মূল্যায়ন করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল দলিল। যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বঙ্গবন্ধুর ভাষণের তাৎপর্যপূর্ণ দিক তুলে ধরে বলেছিলেন, এই ভাষণের মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রমাণ করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিদের কোনোরকম বৈধতা নেই। পূর্ব পাকিস্তান আসলে বাংলাদেশ।
কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন,
শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।
ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭
মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে অন্যতম প্রেরণা হয়ে থাকবে। এই ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের
জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের
অনুপ্রেরণা।
২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবরে
ইউনেস্কো ৭ই
মার্চের ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে
বঙ্গবন্ধুর ৭
মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার মন্ত্রে
উজ্জীবিত করেছিল।
১৮ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণটি সত্যিকার অর্থেই বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ।
৭
মার্চের ভাষণের মাধ্যমে
পাকিস্তানিদের প্রতি
চার শর্ত দেন
বঙ্গবন্ধু:
১. অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে
২. সমস্ত সেনাবাহিনীকে
ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে
৩. নিরস্ত্র গণহত্যার তদন্ত করতে হবে
৪. নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
এই
ভাষণের মাধ্যমে বাঙালি
জাতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর
নির্দেশগুলো হলো:
১. বাংলার মুক্তি
না হওয়া পর্যন্ত খাজনা ট্যাক্স বন্ধ রাখুন।
২. সমগ্র বাংলাদেশের
সেক্রেটারিয়েট- সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট এবং অন্যান্য কোর্টে হরতাল করুন। কোথাও শিথিল করা হইলে জানানো হবে।
৩. রিকশা, বেবি, বাস-ট্যাক্সি প্রভৃতি এবং রেলগাড়ি ও
বন্দরসমূহ চালু রাখুন। কিন্তু জনগণের
ওপর জুলুম চালাবার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর চলাচলের কাজে রেলওয়ে ও বন্দর কর্মচারীগণ সহযোগিতা করবেন না এবং সেক্ষেত্রে
তাদের চলাচলের ব্যাপারে কোনও কিছু ঘটলে আমি দায়ী হবো না।
৪. বেতার, টেলিভিশন ও
সংবাদপত্রসেবীরা আমাদের বিবৃতি-বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ প্রদান করবেন এবং গণআন্দোলনের কোনও খবর গায়েব করবেন না। যদি তাতে বাধা দেওয়া হয়, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাঙালিরা কাজে যোগ দিবেন না।
৫. শুধু লোকাল এবং আন্তঃজেলা ট্রাঙ্ক-টেলিফোন যোগাযোগ অব্যাহত রাখুন।
৬. স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখুন।
৭. সকল গৃহশীর্ষে
প্রতিদিন কালো পতাকা উড্ডয়মান রাখুন।
৮. ব্যাংকগুলো প্রতিদিন দুই ঘণ্টা খোলা রাখুন, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও যেন পাচার না
হয়।
৯. অন্যান্য ক্ষেত্রে আজ থেকে হরতাল প্রত্যাহার করা হইলো। কিন্তু অবস্থার
প্রেক্ষিতে যে
কোনও সময় আবার অংশিক বা
সর্বাত্মক হরতাল ঘোষণা হতে পারে, তার জন্য প্রস্তুত থাকুন।
১০. স্থানীয় আওয়ামী
লীগ শাখার নেতৃত্বে অবিলম্বে বাংলার প্রত্যেকটি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা
ও জেলা পর্যায়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করুন।